Shafiqul Shawon

Md Shafiqul Alam Shawon

শ্রমজীবী মানুষের বেতন ও জীবনচিত্র


আমার বাড়ির কাছেই ২২তলা একটি ভবনে দিনরাত চলে পোশাক তৈরির কাজ। কারখানাটি বেশ বড় আর দেখতেও সুন্দর। কারখানায় যারা কাজ করেন, তারা আশপাশেই বাসাভাড়া (পোশাক শ্রমিকদের জন্যই তৈরি এক রুমের একেকটি বাসা) নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন কাজে যাওয়া-আসা আর দুপুরে খাদ্যবিরতির সময় কারখানার সামনে চলে শ্রমিকদের আনাগোনা। তাদের এ চলাফেরা ও রাস্তা পারাপার নিরাপদ করার জন্য কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা রাস্তার দু’ধারে লাল কাপড় প্যাঁচানো রশি টেনে উঁচিয়ে ধরেন। ফলে রাস্তায় যাতায়াতকারী গাড়ি, বাসগুলোও চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। যতবার যতজন যাওয়া-আসা করে ততবার তারা রশি টেনে ধরেন। দৃশ্যটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কারখানার শ্রমিকদের জন্য মালিকপক্ষ এতটা ভাবে দেখে কার না ভালো লাগবে। কিন্তু এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে হয়, যেমন মনে হয় প্লামি ফ্যাশন ও ভিনটেজ ডেনিমের পরিবেশবান্ধব কারখানা হওয়ার জন্য প্লাটিনাম লিড সনদ আর মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডের ফ্রান্স কর্তৃক দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ স্টার অ্যাওয়ার্ড লাভ করার ঘটনাকে। একে কেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছি, তা বোঝা মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়। প্রতি বছর দুই ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ, ন্যূনতম মজুরি আন্দোলনে গণহারে গ্রেফতার, তাজরীন, রানা প্লাজাসহ অসংখ্য দুর্ঘটনা এবং সম্প্রতি মাল্টিফ্যাবসে ঘটে যাওয়া বয়লার বিস্ফোরণ— এগুলো যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পরে দুর্ঘটনার সময় করণীয় বিষয়ে অনেক প্রশিক্ষণ, কর্মপরিবেশে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অনেক ধরনের আয়োজন, কিছু শ্রমিকের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি ইতিবাচক কর্মসূচি নেয়া হলেও দুর্ঘটনা আর শ্রমিক নিহত হওয়ার পরিসংখ্যানের তুলনায় তা অত্যন্ত নগণ্য।
এসব প্রত্যক্ষ দুর্ঘটনার পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অসংখ্য পরোক্ষ দুর্ঘটনাও ঘটছে। যেমন— যেকোনো আন্দোলনের পরেই কিছু শ্রমিককে আমরা চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে দেখি, যিনি কখনো কখনো হয়ে থাকেন তার পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি। চাকরিহীন অবস্থায় ওই পরিবারটির কী অবস্থা হয়, কেমন করে চলে তাদের দিন আর তা যদি হয় ঈদের কিংবা কোনো পারিবারিক, সামাজিক বা ধর্মীয় কোনো উত্সব-পার্বণের আগে আগে কিংবা পারিবারের কোনো সংকটের সময়! এ অবস্থায় একজন মানুষের যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, তা পরিমাপের কোনো পরিমাপক না থাকলেও এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। আমরা প্রত্যেকেই চাই আমাদের সন্তানরা ভালো থাকুক, ভালো বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করুক, সেই চাওয়া থেকে সন্তানকে ভালো একটা স্কুলে পড়ানোর আকাঙ্ক্ষা কার না থাকে! একজন পোশাক শ্রমিক বা নিম্ন আয়ের শ্রমিক তার আয়ের সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করান। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলে স্কুলে যে কোচিং ব্যবসা আর সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষাক্রমের সিলেবাসে সেট ধরে বই বেচার যে বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তাতে একটি পরিবারের সন্তানের পড়াশোনার পেছনে করা অর্থ ব্যয় সেই শ্রমিকের আয়ের কত ভাগ, তারও কোনো হিসাব বা গবেষণা নেই।
শিল্প-কারখানাগুলোয় কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় শতভাগই গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে স্থানান্তর হয়ে এসেছেন, যাদের শতভাগের ওপর আছে নানা ধরনের ঋণের বোঝা; যার শতভাগ আবার নেয়া হয় ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প থেকে। এর অধিকাংশ সুদই ১২ শতাংশ হারে দিতে হয়। কিছুটা উন্নত জীবনযাপন করতে চাওয়া থেকে ঋণ নেয়া, এক ঋণ শোধ করার জন্য আরেকটি ঋণ নেয়া; তা শোধ করার জন্য বসতভিটা বা ধানী জমি বিক্রি করা; তারপর শহরে এসে কোনো একটা কারখানায় কাজ নেয়া; পরিশেষে আগের তুলনায় আরো নোংরা পরিবেশে, নিম্নমানের খাবার খেয়ে জীবনযাপন করা। এছাড়া মানুষ হিসেবে একজন লোকের থাকে নানা ধরনের শখ-আহ্লাদ, ছেলেমেয়েদেরও থাকে নানা আবদার। তো এ আবদার মেটাতেও তাকে করতে হয় ধারদেনার মতো নানা কসরত। এবার রমজানের ঈদে আমার এলাকার চেনা এক রিকশা শ্রমিককে তার ছেলেমেয়েকে ঈদের জামাকাপড় (কিরণমালা বা পাখি জামা) কেনার টাকা জোগাড় করতে যেতে হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের কাছে, যার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রভাব একসময় হয়ে ওঠে পাহাড়সম। শ্রমবাজারে দিনকে দিন যেখানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, সেখানে কর্মপরিবেশ নারী শ্রমিকের জন্য কতটা উপযোগী? ঋতুচক্রের সময় কারখানাগুলোর পরিবেশ নারী কর্মীদের জন্য হয়ে ওঠে অত্যন্ত প্রতিকূল। এ সময় একজন নারীর টয়লেটে গমনাগমন বেড়ে যায় এবং থাকতে হয় অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই সুরক্ষিত। সেখানে কারখানাগুলোর টয়লেটের অপর্যাপ্ততা ও অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে এরই মধ্যে আমরা ওয়াকিবহাল।
আর এসব বিষয় প্রায়ই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ব্যাপারটি কি এমন যে, এসব বিষয়ের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না তা নয়, এজন্য প্রতিটি কারখানার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আদায় করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারেন। আর এর সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষেরও যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। সরকার যদি এসব শিল্প-কারখানার জন্য নানা রকম ব্যাংকঋণ সুবিধা, টাকায় ভর্তুকি, গ্যাস, বিদ্যুত্ বিলের বিশেষ সুবিধা, আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধা ইত্যাদি দিতে পারে তাহলে শ্রমজীবী মানুষের উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য তাদের প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর অনেক কিছুই করতে পারে। আমি মনে করি, উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে আরো গবেষণা, আলোচনা ও সচেতনতা দরকার। এসব বিষয় একজন শ্রমজীবীর উত্পাদনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যা আবার সম্পর্কযুক্ত কারখানার উত্পাদনশীলতার সঙ্গে; কারখানাগুলোর উত্পাদনশীলতা পরিশেষে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকেই উপস্থাপন করে।  

লেখক: স্বেচ্ছাসেবক
বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউট (বাশি)

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.